বরিশালে দুটিতে নতুন মুখ, দুটিতে এমপি বদল, দুটিতে বহাল

আলোচনা, পর্যালোচনা আর বিশ্লেষণের পর অবশেষে দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেছে ক্ষমতাশীন দল আওয়ামী লীগ। রোববার (২৬ নভেম্বর) বিকেলে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে সংসদ সদস্য হতে ভোটের মাঠে কারা লড়াই করবেন তাদের নাম প্রকাশ করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে বরিশাল জেলার ৬ আসনে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে আনন্দ-উৎসাহ ছড়িয়ে পড়েছে। মনোনীতদের তালিকা ঘোষণার পরপরই আনন্দ মিছিল হয়েছে বরিশাল ৫, বরিশাল ৩, বরিশাল ৪ ও বরিশাল ৬ আসনে। অন্যান্য আসনগুলোতেও নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে এসেছে।

বরিশালের ৬টির মধ্যে দুটিতে বর্তমান সংসদ সদস্য বহাল রয়েছেন। এছাড়া দুটি আসনের বির্তকিত দুই সংসদ সদস্য মনোনয়ন পাননি। ফলে সেখানে নতুন মুখ এসেছে। আর দুটি আসনে নতুন প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই আসন দুটিতে আগে মহাজোটের শরিক দলের প্রার্থী থাকায় প্রার্থী দিতো না আওয়ামী লীগ।

বরিশাল-১ আসন গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত। এই আসনে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে একজনই আবেদন করেছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বর্ষীয়ান নেতা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। তিনিই মনোনয়ন পেয়েছেন। তার বাবা সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত। ১৯৭৫ সালের ভয়াল ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল। ওইদিন আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ তার মা ও সন্তানকেও হারিয়েছিল। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগিনা। তার ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র। 

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে তিনি ১৯৭৩ সালে বরিশাল উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। অধুনালুপ্ত বরিশাল পৌরসভারও চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে বরিশাল-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২৬ জুন ২০০০ সালে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হন। হাসনাত ১৯৯৬ থেকে ২০০০ পর্যন্ত জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ ছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি তৃতীয় বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৮ সালে চতুর্থবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত হন, যা বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পদমর্যাদার। তিনি পার্বত্য শান্তিচুক্তির জন্য বিশেষভাবে প্রশংসীত।

বরিশাল-৫ আসন সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত। এই আসনে সংসদ সদস্য পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক পুনরায় মনোনয়ন পেয়েছেন। জাহিদ ফারুক একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। তিনি বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং সরকারের চতুর্থ পরিষদে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। জাহিদ ফারুকের সঙ্গে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ছেলে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর রাজনৈতিক দূরত্ব রয়েছে। কিন্তু শেষতক জাহিদ ফারুক বহাল রইলেন।

বরিশাল ৩ আসন বাবুগঞ্জ ও মুলাদী উপজেলা নিয়ে গঠিত। এই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান সরদার খালেদ হোসেন স্বপন। তিনি ইউনিয়ন থেকে রাজনীতি শুরু করে আজকে দলীয় মনোনয়ন পর্যন্ত পৌঁছেছেন। স্বপন তার উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। এরপরে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচন করে জয়ী হন। দলীয় নেতৃত্বে সফল হওয়ায় পরপর তিনবার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে। এই আসনটি দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের শরীক জাতীয় পার্টি প্রার্থী দেওয়ায় প্রার্থী দিতো না আওয়ামী লীগ। তবে এবার সেই অবস্থান থেকে ফিরে এসেছে দলটি। দীর্ঘযুগ পরে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় এই আসনে ইতোমধ্যে আনন্দ মিছিল করেছে উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠন।

বরিশাল ৬ আসন বাকেরগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত। এই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজ মল্লিক। তিনি ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল এবং ২০০৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যথাক্রমে একটি

পদাতিক ব্রিগেড এবং একটি পদাতিক ডিভিশনের নেতৃত্বে দেন। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে কমান্ড্যান্ট হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ২০০৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৫ সালে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। অবসর গ্রহণের পরপরই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এই আসন থেকে আরও ১২ জন দলীয় মনোনয়ন চাইলেও দল থেকে তাকে মনোনীত করা হয়। যদিও বরিশাল ৬ আসনটি এর আগে মহাজোটের শরীক জাতীয় পার্টিকে দেওয়ায় দলীয় প্রার্থী দিতো না আওয়ামী লীগ। তবে এবার জাতীয় পার্টির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ প্রার্থিতায় না যাওয়ায় নতুন প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলটি।

বরিশাল ২ আসনটি বানারীপাড়া ও উজিরপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত। বাংলাদেশ সরকারের প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় তার বাবা ও চাচার নাম রয়েছে। যদিও সরদার শাহে আলম ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন ছাত্রলীগ থেকে। এছাড়া তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতিও নির্বাচিত হন। তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরে মুক্তিযোদ্ধারা সংক্ষুব্ধ হন এবং মনোনয়নের প্রতিবাদ জানান। এই আসনে নতুন প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুসকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তিনি বরিশাল-১ আসন থেকে ২০০৮ সালে ও বরিশাল-২ আসন থেকে ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচনে জয়ী হন। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। দশম জাতীয় সংসদের অষ্টম অধিবেশনে প্যানেল স্পিকার পদে মনোনীত হন।

বরিশাল-৪ আসনটি মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলা উপজেলা নিয়ে গঠিত। মেঘনা নদী বিধৌত এই আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ। তিনি স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাবেক সভাপতি। ২০১২ সাল থেকে ওই পদে ছিলেন। দেশে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের সময় ২০১৯

সালের ৩১ অক্টোবর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে দলে সকল কার্যক্রম থেকে সরানো হয়। পঙ্কজ নাথ ছাত্র অবস্থাতেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপরের ২০১৮ সালের নির্বাচনেও নিরঙ্কুশ জয় পান।। বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। পঙ্কজ নাথের কর্মকাণ্ডের ব্যাপক বির্তকের সৃষ্টি হলে উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকেই বিকল্প প্রার্থীর দাবি ওঠে।

এই আসনে মনোনয়ন সংগ্রহ করেন আওয়ামী লীগের আর্ন্তজাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ। তিনি বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের কন্যা। মহিউদ্দিন আহমেদ মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য্। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাজনীতি করতেন। বাবার রাজনীতির হাত ধরে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন ড. শাম্মী আহমেদ। তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কমিটিতে টানা দুইবার আর্ন্তজাতিক বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।