এবিএম আনিসুজ্জামান:
বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ লাখ দলিত জনগোষ্ঠীর বসবাস। আর্থ-সামাজিক সকল বিবেচনায় তারা দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। এই অবহেলিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বাজেটে ধারাবাহিকভাবে পৃথক ও সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন এবং দরিদ্র হিসেবে বাজেটে এই জনগোষ্ঠীর দাবি সর্বাগ্রে বিবেচনার দাবিদার। বিশেষত, আবাসন, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্য বিষয়ে দলিতদের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা প্রয়োজন।বিগত অর্থ-বছর গুলোতে বাজেট প্রণয়নকালে দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণের নিয়মতান্ত্রিক দাবির বিপরীতে সরকারের তরফ থেকে আমরা ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। অর্থ মন্ত্রণালয় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে দলিত, হরিজন, বেদে এবং হিজরা সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নের জন্য ২০১৯-২০ অর্থ বছরেও ৫৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছিলো। এছাড়া দলিত জনগোষ্ঠীর আবাসন ব্যবস্থার উন্নয়নেও ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত চার অর্থবছরে প্রায় ৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। ফলশ্রুতিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধিন শহরাঞ্চলের দলিত জনগোষ্ঠীর আবাসনের জন্য ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এই ধারাবাহিক ইতিবাচক সাড়া প্রদানে অগ্রগণ্য ভূমিকা গ্রহণের জন্য আপনাকে ও আপনার মন্ত্রাণালয়কে বিশেষভাবে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।দলিতদের একটি অংশ নগরাঞ্চলের পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে নিয়োজিত। নগরাঞ্চলের দলিত জনগোষ্ঠীর বসবাস মূলত কলোনিভিত্তিক যা মূলত পৌরসভা, সিটি করপোরেশন এবং রেলওয়ের জমিতে। একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য কলোনিগুলোতে যে কক্ষ বরাদ্দ তার আকার অনেক ছোট। তবে আশার কথা হলো দলিতদের আবাসন তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বরাদ্দের ক্ষেত্রে যাদের সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভায় চাকরি আছে তাদের দেয়ার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এতে করে বিপুল সংখ্যক শহরাঞ্চলের দলিতরা বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অনেক দলিত পল্লী বা কলোনিতে এখনো বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা মানসম্মত নয়। এসবের উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি থাকা আবশ্যক। কেবল একটি দীর্ঘমেয়াদী সমন্বিত প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমেই এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন সম্ভব।বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রথমবারের মতো দলিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের ইস্যু অন্তর্ভুক্ত করে এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মোতাবেক দলিতদের জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দসহ অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও অনগ্রসর ও অনুন্নত দলিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখার কথা ব্যক্ত করেছেন যা আমাদের আনন্দিত করেছে এবং এই মর্মে আশাবাদী করেছে যে, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দলিত জনগোষ্ঠীর স্বার্থ যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হবে এবং আসন্ন জাতীয় বাজেটসহ আগামী বাজেটসমূহে তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন থাকবে।২০১৯-২০, ২০১৮-১৯, ২০১৭-১৮ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সুষ্পষ্টভাবে দলিত শব্দটি উল্লেখ না করে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়, যা দলিত-হরিজন-বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ফলে, দলিত জনগোষ্ঠীর প্রতি আরও বৈষম্যের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কেননা দলিত শব্দটি উল্লেখ না করার কারণে বরাদ্দকৃত বাজেট প্রাপ্তিতে দলিত জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হয়। অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বলতে যেহেতু দলিত, হরিজন, বেদে ছাড়াও আরও অনেক দরিদ্র ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে বুঝানো হয়ে থাকে, সেহেতু সেই বাজেট দলিত সম্প্রদায় ছাড়াও অন্যান্য অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকেও দেয়া হয়। একই সাথে দলিত হিসেবে তারা আলাদাভাবে তালিকাভূক্ত নয়, কাজেই মূলধারার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকেই দলিত হিসেবে পরিচয় দিয়ে এসব বিশেষ সুবিধা ভোগ করার চেষ্টা করছে।সামাজিকভাবে বঞ্চিত দলিত জনগোষ্ঠী উন্নয়নের জন্য ধারাবাহিকভাবে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ ও বিশেষ উন্নয়ন কর্মসূচির দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের এই দাবিকে বিবেচনায় নিয়ে বিগত অর্থবছরগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থবরাদ্দ আশাবাদী করে তুলেছে। সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দলিত জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, আবাসন, পানি ও পয়ঃনিষ্কাষণ সঙ্কট নিরসনে আসন্ন জাতীয় বাজেটে (২০২০-২১) বিশেষ বরাদ্দ ও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ঘোষণা করা, সরকারি সকল নীতিমালায় দলিত ও বঞ্চিত সম্প্রদায়কে যথাযথ স্বীকৃতি দেয়া, দেশে দলিত জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য আদমশুমারীতে পৃথকভাবে চিহ্নিত করে গননা করা। যাতে করে এই জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ ও সংখ্যানুপাতের ভিত্তিতে উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ দেয়া যায়। দলিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা দিতে বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা, দলিত জনগোষ্ঠীর পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকিকে বিশেষ বিবেচনায় এনে তাদের স্বাস্থ্যসুরক্ষার সকল উপকরণ চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহের জন্য বাজেট বরাদ্দ করা শহরাঞ্চলে বিভিন্ন দলিত ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য আবাসন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দলিতদের দাবি শহরাঞ্চলের দলিতদের জন্য আবাসন বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রে চাকুরিতে নিয়োজিত থাকা বা না থাকার বিষয়টি বিবেচনায় না এনে সকলের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা। কারণ দলিতদের সকলের চাকরির নিশ্চয়তা নেই এবং অস্পৃশ্যতার কারণে কলোনীর বাইরে তাদের বাড়ি ভাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া দলিতদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও পেশাগত কারণে একসাথে থাকা বাঞ্চনীয়, কাভিড-১৯ ক্ষতিগ্রস্থ দলিতদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেয়া এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় রেশন কার্ডের ব্যবস্থা করা।আমরা আশা করি, আসন্ন জাতীয় বাজেটে ‘দলিত’ শব্দটি যথাযথভাবে বহাল রেখে দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর আবাসন, দীর্ঘমেয়াদী রেশনিং, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সঙ্কট নিরসনে বিশেষ বরাদ্দ ও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ঘোষণা আসবে; যার মধ্য দিয়ে এই সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে অগ্রগতি সাধিত হবে।লেখক: উন্নয়ন কর্মী, নাগরিক উদ্যোগ