মধ্যরাতে লঞ্চেই নিরাপদে বাচ্চা প্রসব

যাত্রাপথে হৃদরোগে কিংবা অন্য কোনো শারীরিক সমস্যায় মৃত্যু শয্যায় চলে যাওয়া এবং কিছু মানুষের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সহায়তায় সেখান থেকে সুস্থ হয়ে আবার নতুনভাবে জীবন শুরু করার ঘটনা ‌‘The Good Doctor’ সহ বিভিন্ন সিনেমাতে দেখা গেছে। বাস্তবে এমন ঘটনা ঘটলেও খুব কমই শোনা যায়। 

সম্প্রতি ঢাকা-বরিশাল রুটের যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি মানামীতে এমনই মানবিক একটি ঘটনা ঘটেছে। এক গর্ভধারিনী মা নিরাপদে তার সন্তান প্রসব করেছেন এবং কিছু মানবিক মানুষের হাত ধরে পৃথিবীর আলো দেখাতে পেরেছেন। 

ঘটনার বর্ণনা এমভি মানামী লঞ্চ কর্তৃপক্ষ গত রোববার (৫ জুলাই) রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তুলে ধরলে কুড়াতে থাকেন বাহ বাহ। তাদের জন্য অনেকেই যেমন দোয়া করেছেন, তেমনি ঘটে যাওয়া কাজটিকে নিয়ে প্রশংসাও করেছেন।

ঘটনার সূত্রে জানা গেছে, গত ২ জুলাই রাতে ঢাকা থেকে বরিশালের উদ্দেশে যাত্রী নিয়ে রওয়ানা হয় বিলাসবহুল এমভি মানামী লঞ্চ। মধ্যরাতে কেবিনের এক নারী যাত্রী বাথরুমে যাওয়ার সময় প্রসব বেদনায় প্রথম শ্রেণির করিডোরে বসে পড়েন। বিষয়টি তাৎক্ষণিক কেবিন ক্রুদের চোখে পড়ে। তারা কাছে গিয়ে ওই নারীকে সহায়তা করেন এবং জানতে চান তার কী সমস্যা হয়েছে। ওই নারী তখন কেবিন ক্রদের জানান তার প্রসব বেদনা শুরু হয়েছে। বিষয়টি জানতে পেরে ক্ররা তাৎক্ষণিক তাকে কেবিনে নিয়ে যান। তবে ওই নারীর সঙ্গে আর কোনো সহযাত্রী না থাকায় এবং কেবিন ক্রুরা পুরুষ হওয়া পাশের কেবিনের অপর এক নারীকে সহায়তার আবেদনে ঘুম থেকে ওঠান। এরপর ওই নারী বিষয়টি বুঝতে পেরে লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে একজন চিকিৎসক ও ধাত্রীর প্রয়োজনের কথা জানান। 

কিন্তু মধ্যরাতে বৃহত্তর মেঘনার মাঝ নদীতে চিকিৎসক কিংবা প্রশিক্ষিত ধাত্রী কীভাবে পাবেন। এরপর লঞ্চের সিনিয়র সুপারভাইজার শাহাদাত হোসেন শুভর নির্দেশে পুরো লঞ্চে চিকিৎসক কিংবা প্রশিক্ষিত ধাত্রী খোঁজা শুরু হয়। এজন্য যাত্রীদের কেবিনের রেজিস্টার খাতা দেখার পাশাপাশি মাইকেও ঘোষণা দেওয়া হয়। যেখানে একজন চিকিৎসক ও ধাত্রীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

সৌভাগ্যক্রমে ওই লঞ্চের যাত্রী ছিলেন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. মুহাম্মদ রেজাউল কবির ও মিডওয়াইফ (ধাত্রী) মিসেস শিরিন। যারা লঞ্চ কর্তৃপক্ষের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মধ্যরাতেই প্রসূতি মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। যদিও এরইমধ্যে মাত্র সাত মাসের প্রি-ম্যাচিউর নবজাতকের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

তারপরও চিকিৎসক ও ধাত্রীর চেষ্টায় লঞ্চের কেবিনেই নিরাপদে ছেলে সন্তানের জন্ম দেয় সেই গর্ভধারিনী। আর এ কাজকে নিরবচ্ছিন্ন ও নিরাপদে সম্পাদন করার জন্য লঞ্চের ডেক এবং কেবিন ক্রুসহ ৪০ জনের স্টাফ যথাসাধ্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর ছিলেন ঘটনার সময়। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো প্রকার জনসাধারণের ভিড় বা ফটোগ্রাফি নেওয়া থেকে বিরত রাখতে কেবিন এরিয়ায় নিরাপত্তা বেষ্টনী গঠন করে তাদের প্রাইভেসি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করেছেন।

বিষয়টি নিশ্চিত করে সোমবার (৬ জুলাই) সকালে এমভি মানামী লঞ্চের সিনিয়র সুপারভাইজার শাহাদাত হোসেন শুভ বলেন, যাত্রাপথে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি, যা মানামী লঞ্চ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা সবসময় সমাধান করার চেষ্টাও করে থাকি। তবে এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার কখনো হবো তা ভাবিনি। বিশেষ করে প্রি-ম্যাচিউর নবজাতকের জন্য আমাদের অনেকটা সময় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে। চিকিৎসক-ধাত্রীসহ আমাদের সব স্টাফদের একটাই চেষ্টা ও সৃষ্টিকর্তার কাছে কামনা ছিল যেন, মা ও সন্তান সুস্থভাবে বেঁচে থাকেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর যখন গর্ভধারিণী ওই নারী নিরাপদে বাচ্চা প্রসব করলেন তখন একটা আলাদা অনুভূতি কাজ করছিল সবার।

তিনি বলেন, আমরা ওই নারীর নিরাপত্তার খাতিরেই রাতে সর্বোচ্চ গতিতে লঞ্চ চালনার নির্দেশ দিয়েছিলাম। যে কারণে নির্ধারিত সময়ের বহু আগে গত ৩ জুলাই ভোররাত ৩টা ১৭ মিনিটে বরিশাল ঘাটে পৌঁছাতে সক্ষম হই। এদিকে ওই নারীর স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আগেই ঘাটে অ্যাম্বুলেন্স আনিয়ে রাখা হয়েছিল।

লঞ্চ ঘাটে নোঙর করার পরপরই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার দীর্ঘ সময় পার করে ঘাটে অপেক্ষমান পরিবারের কাছে নিরাপদে মা ও নবজাতককে হস্তান্তর করা হয়। পাশাপাশি ওই নারী ও তার ছেলে সন্তানকে তাদের স্বজনদের উপস্থিতিতে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেওয়া হয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মা ও সন্তান উভয়ই ভালো রয়েছেন। তারা বাড়িতে চলে গেছেন।