দূর থেকে পাখির চোখে (ড্রোন শট) দেখলে মনে হবে যেন সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে অসংখ্য লাল গালিচা। তবে কাছে গেলেই বোঝা যায় আসলে এগুলো পাকা মরিচ। যা স্থানীয় কৃষকরা শুকাতে দিয়েছেন রেললাইনের ধার ঘেঁষে। এ দৃশ্য ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা রুহিয়া রেলস্টেশন এলাকার।
মরিচ শুকিয়ে বাজারজাত করলে ভালো দাম পাওয়া যায়। তাই প্রতিদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বস্তায় বস্তায় পাকা মরিচ রেললাইনের দুই পাশে ও পাটাতনের মাঝখানে পাটি, মাদুর, পলিথিন বিছিয়ে শুকাতে দেয় কৃষকরা। সম্পূর্ণ শুকানো হলে প্রক্রিয়াজাত শেষে সেসব মরিচ বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়।
রুহিয়া এলাকার মরিচ চাষি লিটন সরকার বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার ঠাকুরগাঁওয়ে মরিচের বাম্পার ফলন হয়েছে।
প্রতিদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ক্ষেত থেকে মরিচ সংগ্রহ, শুকানো ও বাজারজাত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা।
একই এলাকার কৃষক আব্দুস সামাদ জানান, তিনি এ বছর তিন বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছেন। প্রতি একবিঘা জমিতে মরিচ চাষে বীজ ক্রয়, হাল, সার, কীটনাশক ও সেচসহ প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আর প্রতি বিঘায় উৎপাদিত মরিচ শুকিয়ে বিক্রি হচ্ছে প্রায় দেড়লাখ টাকা, অর্থাৎ প্রতি বিঘায় খরচ বাদে তার লাভ হয়েছে একলাখ দশ হাজার টাকা।সদর উপজেলার রুহিয়া, ঢোলারহাট, আখানগর এলাকার প্রায় ৭০ ভাগ কৃষকই মরিচ চাষ করে থাকেন। পৌষ মাসে মরিচের চারা রোপণ করার পর থেকে মরিচ উৎপাদন পর্যন্ত প্রায় ছয় মাস সময় লাগে। এ বছর বিন্দু, সেকা, মাশকারা, মল্লিকাসহ বিভিন্ন জাতের মরিচ চাষ হয়েছে এই এলাকায়।
রুহিয়া ঢোলারহাট এলাকার কৃষক মোস্তফা কামাল বলেন, কাঁচা অবস্থায় মরিচের দাম কম থাকে। এ কারণে শুকিয়ে বিক্রি করলে ভালো দাম পাওয়া যায়।মরিচ তোলার পর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাক নিয়ে এখানে মরিচ কিনতে আসেন ব্যবসায়ীরা। অনেকে কাঁচা মরিচ ও অনেকে শুকনো মরিচ ক্রয় করে নিয়ে যান। প্রকারভেদে কাঁচা মরিচ প্রতিমণ আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা এবং শুকনো লাল মরিচ ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে।
ঢাকার কেরাণীগঞ্জ থেকে আসা মরিচ ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, তিনি প্রতিবছর এই মৌসুমে ঠাকুরগাঁও আসেন মরিচ ক্রয়ের জন্য। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার মরিচের মান যথেষ্ট ভালো। তিনি এ পর্যন্ত ছয় মেট্রিক টন কাঁচা মরিচ ও দুই মেট্রিক টন শুকনো মরিচ ক্রয় করে ঢাকা পাঠিয়েছেন।
ভালো দাম পেয়ে খুশি কৃষকরা। সেই সাথে ক্ষেত থেকে মরিচ তোলা ও শুকানোর কাজে জড়িত কয়েকশত শ্রমিকের প্রতিদিন আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিজন শ্রমিক কমপক্ষে পাঁচ-ছয় ডালি মরিচ তুলতে সক্ষম হচ্ছেন। প্রতি ডালি ৫০ টাকা হিসাবে দিনে আয় করছেন কমপক্ষে আড়াইশ টাকা থেকে ৩০০ টাকা।
ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার মোছাম্মাৎ শামীমা নাজনীন জানান, মরিচ চাষ লাভজনক হওয়ায় জেলায় দিন দিন মরিচ চাষে আগ্রহী হচ্ছেন কৃষকরা। উৎপাদিত মরিচ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ও চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। মরিচ চাষে কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। জেলায় এবার দেশি প্রজাতি বাদেও জিরা, মল্লিকা, বিন্দু, হটমাস্টারসহ বিভিন্ন হাইব্রিড জাতের মরিচ আবাদ হয়েছে। চলতি মৌসুমে জেলায় ১৬শত ৫৩ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হলেও আবাদ হয়েছে ১৬শত ৫৬ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা তিন হাজার ১৪১ মেট্রিক টন ধরা হলেও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে উৎপাদন হবে তিন হাজার ৮৬৫ মেট্রিক টন। এ বছর হেক্টর প্রতি ফলন হয়েছে দুই হাজার ৫৭৫ মেট্রিক টন। মোট উৎপাদন থেকে প্রায় দেড়শত কোটি টাকার মরিচ রপ্তানি করা সম্ভাবনা রয়েছে।